শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১১

বাড়ছে বাংলামতির আবাদ

সোহরাব হোসেন বিটুল
বাংলামতি এক ধরনের সুগন্ধিজাতীয় ধান। এ ধানের ফলন একর প্রতি প্রায় ৭০ থেকে ৯০ মণ অর্থাৎ বিঘা প্রতি ২৫ থেকে ৩০ মণ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের অনেক এলাকায় বাংলামতি ধান চাষ হচ্ছে। এ ধান মৃদু লবণসহিষ্ণু। উৎপাদনের দিক থেকে বাসমতির চেয়ে বাংলামতি প্রায় দ্বিগুণ। অন্য ধানের চেয়ে এ ধানের উৎপাদন খরচও অনেক কম। দুই বছর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এই ধান উদ্ভাবনের পর ফলন হেক্টরপ্রতি সাড়ে ৬ থেকে ৭ মেট্রিক টন নির্ধারণ করলেও বাস-বে তা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৫৫টি জেলায় এ ধানের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধান চাষে প্রাথমিকভাবে সাফল্য অর্জিত হলেও এ ধান থেকে চাল করাই প্রধান সমস্যা ছিল। তবে এর সমাধান নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে বাংলামতি ধান থেকে উন্নতমানের চাল বের করার উপায় উদ্ভাবন করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব মতে, গত মওসুমে সারা দেশে আট হাজার হেক্টর জমিতে এ ধান চাষ হয়, যার মধ্যে খুলনা-যশোর অঞ্চলে হয় অর্ধেক। এ বছর চলতি বোরো মওসুমে সারা দেশে সুগন্ধি বাংলামতি ধানের আবাদ এক লাখ হেক্টর অতিক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্রি’র তথ্য ও মাঠপর্যায়ে মিলিং অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়েছে, এ ধান কাটার পর যাতে বৃষ্টির পানিতে ভিজে না যায় সে দিকে নজর রাখতে হবে। ধানে শিশির লাগানো যাবে না এবং কাটার পরপরই তা পালাজাত করে রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ধান কাটার পরপরই তা মাড়াই করে কমপক্ষে এক দিন রোদে শুকিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া বাংলামতি ধান মিলিংয়ের আগে ঠিকমতো শুকাতে হবে। সেদ্ধ চাল করতে অবশ্য তেমন কোনো সমস্যা নেই। আতপ চাল করার ক্ষেত্রে চাল ভেঙে যাওয়ার কিছুটা সমস্যা রয়েছে। তবে আতপ চালের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু সতর্কতার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৮-২০ ঘণ্টা রোদে শুকানো প্রয়োজন। একসাথে টানা চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি রোদ লাগানো যাবে না। তাই প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা করে চার-পাঁচ দিন সময় নিয়ে মোট ১৮-২০ ঘণ্টা রোদ দিলেই যথেষ্ট। ১৫-১৬ ঘণ্টা রোদের পর চাল বের করে দেখতে হবে তা শুকিয়েছে কি না। দাঁতে চাপ দিয়েই তা বোঝা যায়। যদি এ-পর্যায়ে ধান ভালোভাবে শুকিয়ে যায় আর রোদে না দিলেও চলে। এরপর যে অটো রাইস মিলে রাবার হোলার আছে সেখানে আতপ চাল ভালোভাবে করা যাবে।
এ ধান থেকে চাল করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং অভ্যন-রীণ বাজারে চাল প্রক্রিয়া ও বাজারজাতকরণে দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি আধুনিক অটো রাইস মিল এগিয়ে আসায় চলতি বোরো মওসুমে দেশে বাংলামতি ধানের আবাদ এক লাখ হেক্টর অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাজীপুরের চাচাভাতিজা অটো রাইস মিলে পরীক্ষামূলক মিলিং করে উন্নতমানের চাল তৈরি করা হয়। ফলে কৃষকের দুশ্চিন-া অনেকটা দূর হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ফিল্ড সার্ভিসের পরিচালক মো: ইউনুছ আলী বলেন, বাংলামতি ধান চাষের প্রথম দিকে কৃষক এবং মিলিংপর্যায়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল ইতোমধ্যে তার অনেকটা অবসান হয়েছে। রাবার হোলার আছে এমন অটো রাইস মিলে এ ধান থেকে চাল করার ক্ষেত্রে এখন তেমন কোনো অসুবিধা নেই। মাঠপর্যায়ে এ ধানের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। গত বছরের চেয়ে চলতি বোরো মওসুমে কয়েক গুণ বেশি জমিতে বাংলামতি ধান চাষ হবে বলে তিনি আশা করেন।
ব্রি’র মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন- যত ধরনের ধান চাষ হয় তার মধ্যে বাংলামতি (ব্রি ধান-৫০) হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধান। ধানের আকার, গুণগতমান, ফলন ও অন্য সব দিক মিলিয়ে বাংলামতি হচ্ছে বাংলার ধানের রানী বা বাংলামতি। এতটা চিকনমানের লম্বা সুগন্ধি ধান যেমন আর বাংলাদেশে নেই, তেমনি নন-হাইব্রিড হওয়া সত্ত্বেও বাংলামতির ফলন হাইব্রিড ধানের কাছাকাছি। নন-হাইব্রিডের মধ্যে একমাত্র ব্রি-২৯ ছাড়া অন্য কোনো ধানের ফলন এর ওপরে নেই। বাংলামতি ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর চালে হালকা সুগন্ধি রয়েছে। ফলে আমাদের দেশের কালোজিরা, চিনি আতপ বা কাটারির চালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাংলামতি ধানের চাল বাজারজাতকরণে এগিয়ে এসেছে আধুনিক অটো রাইস মিলগুলো। এ বছর নওগাঁর ম্যাবকো গ্রুপ ও কুষ্টিয়ার স্বর্ণা অটো রাইস মিল প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে বাংলামতি চাল বাজারজাত করা শুরু করেছে। স্বর্ণার পরিচালক সাফায়েত হোসেন বলেন, তাদের প্রক্রিয়াজাত করা বাংলামতি চাল প্রধানত ঢাকার বাজারে চাহিদা বাড়ছে। এবার বোরো ফসল তোলার পর তারা এককভাবে এ ধান সংগ্রহ ও চাল বাজারজাত করবেন। একই এলাকায় অবসি'ত আধুনিক অটো রাইস মিল রশিদ অ্যাগ্রো ফুড কর্তৃপক্ষ জানান, তারা মূলত এত দিন মিনিকেট চাল প্রক্রিয়া ও বাজারজাত করে আসছেন। গত বছর প্রয়োজনীয় পরিমাণ বাংলামতি ধান না পাওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলামতি চাল বাজারজাত করতে পারেননি। চলতি বোরো মওসুমে উৎপাদিত বাংলামতি ধান সংগ্রহ এবং এর চাল তারা বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যশোরের নওয়াপাড়ায় অবসি'ত আধুনিক মজুমদার অটো রাইস মিল কর্তৃপক্ষ জানান, পর্যাপ্ত বাংলামতি ধান পেলে তারাও আগামী মওসুমে এ ধান সংগ্রহ ও নিজস্ব ব্র্যান্ডে চাল বাজারজাত করবেন। নাটোর, নওগাঁ ও দিনাজপুরে আতপ চাল তৈরির প্রসিদ্ধ মিলের মধ্যে কয়েকটি আগামী মওসুমে আতপ চাল বাজারজাত করবে বলে জানিয়েছে। দেশীয় মিলার ও চাল ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসায় বাংলামতি ধান ও চালের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ দিকে খুলনার নিউমার্কেটের একজন চাল বিক্রেতা জানান, যারা একবার তার দোকান থেকে বাংলামতি চাল নিয়েছেন তারা আবার এ চাল খুঁজছেন। কারণ দাম একটু বেশি হওয়া সত্ত্বেও এ চালের ভাত অন্য চালের চেয়ে সরু ও সুস্বাদু।
বাংলামতি ধান চাষের অগ্রবর্তী উদ্যোক্তা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান জানান, গত মওসুমে বাংলামতি ধানের উৎপাদন আশাব্যঞ্জক হলেও চাষিরা এ ধান বিক্রি করতে সমস্যায় পড়েন। অপরিচিত ধান হওয়ায়, তার ওপর আতপ চাল ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন। এটি ঠিক, যেহেতু নন-হাইব্রিড ধান হিসেবে বাংলামতি ধানের ওপর আর কোনো সরু ও সুগন্ধি ধান নেই। তাই এ ধানের চাল অবশ্যই ভোক্তারা পছন্দ করবেন। দেশীয় বড় বড় অটো রাইস মিলার ও বাজারজাতকারীরা এগিয়ে আসায় আগামী মওসুমে বাংলামতি ধান বিক্রি ও চাল তৈরিতে সমস্যা এতটা থাকবে না বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, তার ক্ষেতের সংরক্ষিত বীজ ধান এ বছরও রাজশাহী, দিনাজপুর, মাগুরা, ফরিদপুর, নাটোর এলাকার কৃষকেরা নিয়ে যাচ্ছেন। চিকন ও সুগন্ধি ধানের দেশের প্রধান আবাদ অঞ্চল হিসেবে দিনাজপুর ও নাটোর এলাকায় এ ধানের আবাদ বাড়লে আতপ চাল বাজারজাতকরণে সুবিধা হবে এবং রফতানিতেও অনেকে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি মনে করেন। এক মণ বাংলামতি ধান থেকে প্রায় ২৫ থেকে ২৮ কেজি আতপ চাল পাওয়া যায়। উন্নতমানের মিলে চাল ভাঙার পরিমাণ ৩ থেকে ৫ শতাংশ এবং সাধারণ অটো রাইস মিলে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন-। যেহেতু এতটা লম্বা মানের ধান ভাঙানোর প্রযুক্তি এখনো মিলে সংযোজন হয়নি, তাই আতপ চালে ভাঙার পরিমাণটা একটু বেশি। ভাঙা চাল দিয়ে উন্নতমানের সুজি বা চালের গুঁড়া তৈরি ছাড়াও ফিরনি তৈরিতে কাজে লাগানো সম্ভব। যেকোনো অটো রাইস মিলে প্রচলিতভাবে এক মণ বাংলামতি ধান থেকে ২৬ কেজি সেদ্ধ উন্নতমানের চাল পাওয়া সম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন